ক.
চরম ডান বা চরম বাম দলগুলোর মধ্যে একটা চমৎকার মিল আছে! তারা খুবই সুশৃংখল এবং সংগঠিত হয়, সেই সঙ্গে আদর্শের ব্যাপারে আপোষহীন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সমমনা দলগুলোকে আমি এদের মধ্যে ধরছি না। সর্বহারারা আসতে পারেন যদিও ডাকাতি, চাঁদাবাজি এবং নারীনির্যাতনেই তাদের আদর্শ এখন ডুব দিয়েছে। চরম ডান বলতে কী জামাতে ইসলামী আসবে? পুরোপুরি নয়। সমপ্রতি সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে শোর ফেলে দেওয়া তথাকথিত ইসলামপন্থী দলগুলো নিঃসন্দেহে এ তালিকায় ওপরে। কিন্তু বেশ কজন জঙ্গী ধরা পড়ার পর 'আগে শিবির বা জামাত করতাম' জাতীয় স্বীকারোক্তি দেওয়ায় এটা মোটামুটি পরিষ্কার জামাত-শিবির তাদের মোহভঙগ করায় অন্যপথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে তারা। 'ইসলামী বিপ্লব জামাতের এজেন্ডায় এখন নেই। তারা এখন অন্য ধান্দায়। এতবড় ভূমিকা আমার মূল আলোচনায় প্রাসঙ্গিক কিনা এখনই নিশ্চিত নই। লিখতে থাকি, পড়তে থাকেন।
খ.
ব্লগে ইদানিং রাজাকার প্রসঙ্গটাই তুমুল হট আইটেম- সঙ্গে জামাত এবং পক্ষে-বিপক্ষে জমজমাট বিতর্ক। আমি কোন পক্ষে? উত্তর আসছে। তার আগে বলে নিই, এই উপমহাদেশেই শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ নিয়ে ফায়দা লোটে একদল। অভিধানিক নাম ধর্ম ব্যবসায়ী। এরা আগেও ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রেক্ষাপট যখন বাংলাদেশ, তখন বলতেই হয় প্রচণ্ড ধর্মভীরু জাতি আমরা। আর সেই বিশ্বাস ভাঙ্গিয়ে এবং একরকম ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে যারা আখের গুছিয়ে নিয়েছে তাদের সংগঠিত দলটির নাম হতে পারে জামাত। তবে '71র জামাত আর সামপ্রতিক জামাত এক নয়- এই বিশ্বাস যাদের তাদের সুখস্বপ্নে জল ঢালতেই হচেছ এই বলে যে 'এরা একটা নির্দিষ্ট আদর্শে বিশ্বাসে' এবং তা থেকে টলবার নয়। আওয়ামী লিগ বা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো বুর্জোয়া দলগুলো নিজেদের আদর্শ (যদি সেরকম কিছু আদৌ থাকে) বিসর্জন দিয়ে অবলীলায় ফুলের মালা নিয়ে বিপ দলে যোগ দিতে পারে। জামাত থেকে তা সম্ভব নয়। এ কারণেই তাদেও কর্মী, সমর্থক একেবারে অঙ্কের মতো হিসেব করা_ এক চুলও এদিক ওদিক হয় না। (দুয়েকটা ব্যাতিক্রম থাকতেই পারে, তা নিয়ম বলে ভাববেন না)
গ.
একাত্তরে জামাতের আদর্শ ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা যাবে না এবং ভারতের গোলাম হওয়া যাবে না। নতুন মিলেনিয়ামে তাদের ভাবনা মোড় নিয়েছে_ এদেশটাকেই আমরা পাকিস্তান বানিয়ে নিই না কেন! সম্ভব অসম্ভব পরের কথা- এ লক্ষ্যে তারা গুছিয়ে এগিয়ে গেছে বহুদূর। আর তাতে কখনো কাঁধ পেতে দিয়েছে আওয়ামী লিগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। '75 পরবর্তী পুনর্বাসনে গোলাম আযম তার নাগরিকত্ব উদ্ধারের পাশাপাশি যে কাজটি নিশ্চিত করেন তা হলো সারা দেশে তখন পর্যন্ত রাজাকার বলে নিগৃহিতদের একটা হিল্লে করা। আশির দশকের সাপ্তাহিক বিচিত্রার একটি প্রবন্ধ ডিটেলে তুলে ধরেছিল ব্যাপারটা- উদাহরণ হিসেবে ছবিসহ দিয়েছিল এক কানকাটা রাজাকারের প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে আনার ছবি।
ঘ.
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় আমার বয়স সাড়ে তিন। সেইরকম কোনো স্মৃতি মনে নেই। আবছা মনে পড়ছে ব্রাক্ষনবাড়িয়ার পাইকপাড়ায় আমাদের বাসার সামনে রামকানাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যামপ, প্রথম স্টেনগান ছুঁয়ে দেখা, চোখ বাঁধা ট্রাক বোঝাই বাঙ্গালীর বধ্যভূমি যাত্রা, আমাদের ময়না মিঠুর 'জয় বাংলা' শ্লোগান, ট্যাঙ্কের পাড়ে হেলিকপ্টার থেকে মিত্র বাহিনীর শিখ কমান্ডারের অবতরন, বাবাকে না পেয়ে আমাদের বাসা লুট এবং চাকর কবিরকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া। মনে আছে বোম্বিং হবে এই ভয়ে আমাকে বুকে নিয়ে ট্রেঞ্চের দিকে ছুটছে আমার গর্ভবতী মা। রমজান মাসে কর্ণেল সাহেব ইফতারির দাওয়াত দিয়েছিলেন। বাবা কি মনে করে ঘুরপথে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন। ফলে ভৈরব ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে মারা 32জন ডাক্তার-ইনজিনিয়ার ও বুদ্বিজীবির সঙ্গী হতে হয়নি তাকে। বাবা ডায়েরি রাখতেন। পরে এতে যোগ হয়েছে বিজয়ের পর প্রকাশিত পত্রিকাগুলোয় যুদ্ধকালীন প্রতিদিনকার ভয়াবহ সব কিপিং। বাবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি পান্ডুলিপি করে গেছেন। বাংলা-ইংরেজি দুভাষাতেই। কিন্তু এর প্রকাশনা দেখে যেতে পারেননি টাকার অভাবে। আশা রাখি একদিন তা প্রকাশের সামর্থ্য আমার হবে।
ঙ.
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি, ও তা নিয়ে এখন দেশ বিভাজন চলছে বলে যারা বুলি কপচান, তারা হয় সত্যি জানেন না নয়তো তা স্বীকার করতে লজ্জা পান। '71-এ কারা লড়াই করেছে? 12 বছরের শহীদ যে বাঘা সিদ্দিকীকে বলেছিলেন 'গ্রেনেড দেন খানগো মারুম' কিংবা 65 বছরের কৃষক বশিরউদ্দিন যে চওড়া কাধে মর্টারের ভার নিয়ে অবহেলায় সতীর্থদের বলেছিলেন, 'কী যে কও ভাতিজারা, গরু না থাকলে এই কাধে জোয়াল বইছি, আর এইডা কী ভার?' কিংবা আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলের তরুন ডাক্তার শাহআলম বীরোত্তমের কথা যিনি ক্যারিয়ারের চেয়ে দেশ বড় ভেবে খরস্রোতা কর্ণফুলি সাঁতরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন শত্রুজাহাজ- তারাই কী শুধু! তারাও, যারা জানের মায়া না করে ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন গেরিলাদের, না খেয়ে খাইয়েছেন সোনার ছেলেদের- ওরা একটি পতাকার জন্য জান লড়িয়ে দিচেছ, এই ভাবনায়। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তখন মুক্তিযোদ্ধা। এবং রাজাকার- তাদের পতাকা চাঁনতারা। মুখে পাকসারজমিনবাদ...।
চ.
আরেকটু পেছনে ফেরা যাক। '70র নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল বাঙ্গালীদের সংখ্যাগরিষ্ট ভোট পেয়েছিলেন। একটাই ডাকে- ভোট দাও আমি তোমাদের নিজের দেশ দেব। 25 মার্চ রাতে পাকিসতানি সেনাবাহিনী চরম হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ার পর, মুজিব বন্দী হলেন। তার সঙ্গীরা পাল্টা প্রতিরোধের বাণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন এদিক ওদিক, কেউ বা সীমানার বাইরে। তখন বন্দুকের নল খুঁজে বেরাচেছ আওয়ামী লিগ আর হিন্দুদের। এই সময় ফিল্ডে নামল যে দুটি দল তারা হচেছ মুসলিম লিগ ও জামাতে ইসলামি- পাকিদের কাছে বিহারিদের পর সাচচা মুসলমান ও পাকিস্তানি। তাদের কাজ দেশদ্রোহী যারা ভারতের দালালী করে পাকিস্তান ভাঙতে চায় তাদের চিহ্নিত করা ও ধরিয়ে দেওয়া। মুসলিম লিগ একটু মাঝামাঝি বিবেকের, সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে তারা গঠন করল শানতি কমিটি। জামাত এক কাঠি বাড়া- রাজাকার। কি সুন্দর নাম! স্বেচছা সেবক- আসল অর্থ ঘাতক-দালাল। কোন বাড়িতে সুন্দরী মেয়ে আছে, কার টাকা পয়সা আছে, হিন্দু কই, কোন বাড়ির ছেলে দেশের ডাকে ঝাঁপ দিছে, তালিকা করো, জ্বালাও পোড়াও। একেক জায়গায় অবশ্য একেক রকম। তুমুল যুদ্ধের সময় তাদের লুঙ্গির উপর খাঁকি ইউনিফর্ম জুটছে, আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল। পাকিরা বাঙ্কারে মাইয়া লইয়া ফুর্তি করে, তারা বাইরে পাহারা দেয়- আর অপেক্ষায় থাকে যদি ঝুটা জুটে। হাজার হোক মালে গনিমত! শত্রু সমপত্তি- জায়েজ আছে! 10 লাখ বাঙ্গালী বীরাঙ্গনা তাদের দালালীতে সম্ভ্রম খুইয়েছেন। লাখখানেক যুদ্ধশিশুকে '72 সালে বিদেশে চালান করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ফিরে এখন মাকে খোঁজে। কিন্তু কে স্বীকার করবে সেই অপমান!
ছ.
ব্যাতিক্রম ছিল শুনেছি। অনেকে জান বাঁচাতে রাজাকারের তালিকায় নাম তুলেছে। কেউবা ফায়দা লুটতে। কেউ কেউ নাকি গোপনে মুক্তিদের সাহায্যও করেছে। বিবেকবান রাজাকার! শহুরে পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন। জামাত ও শিবির (তখন নাম ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ) মহানবী ও ইসলামের বিখ্যাত বিজয় বদর যুদ্ধের অপমান করে মাঠে নামে 'আল বদর' নাম নিয়ে। আল-শামস নামটা কোত্থেকে এসেছে জানি না। তবে এরা ছিল জেনুইন কিলার- তাও পারভার্ট ধরনের। বুদ্ধিজীবি হত্যার নীলনক্সা ও বাস্তবায়ন ঘটায় তারাই; যার প্রথম সারির নেতা ছিলেন এখন কার দুই জামাতি মনত্রী নিজামী ও মুজাহিদ। ফকিরাপুলে মুজাহিদ পাকিসতানের পতাকা হাতে সামরিক মার্চ করছে-এমন ছবি আছে। যুদ্ধ শেষে এরা কোথায় ডুব দিয়েছিল সেটা গবেষনার বিষয়। কিন্তু পাকরা তাদের দোসরদের পালাবার সময় সঙ্গী করেনি। বলা হয় তারা অনেকেই লুটের সোনাদানার কিছুটা বখরা দিয়ে জানের সদকা কিনেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেও মাঝেও ঢুকে পড়েছিল কিছু। 16 ডিসেম্বর বেশ কিছু এ জাতীয় লোক কুড়িয়ে পাওয়া রাইফেল নিয়ে 'জয় বাংলা' শ্লোগান নিয়ে শরিক হয়েছিল বিজয় মিছিলে। তাদের রসিকতা করে বলা হতো 'সিক্সটিনথ ডিভিশন'। এবং অধঃপতিতরাও আছেন। মায়ার কথাই ধরুন। '71-এ রাজধানীর বুকে শত্রুসেনার ঘুম হারাম করা 'ক্র্যাক' প্লাটুনে'র সদ্যস্য ছিলেন তুমুল সাহসী এই যুবক। পেয়েছেন বীর বিক্রম খেতাব। অথচ ক্ষমতায় গিয়ে বিকিয়ে দিলেন তার চেতনা ও আদর্শ। উনি একটি উদাহরন মাত্র। আমরা কত সসতাতেই কমপ্রোমাইজ করি!
জ.
তাহলে শেখ মুজিব কেন এদের ক্ষমা করলেন- এই প্রশ্ন অনেক অর্বাচীনের। মানুষটার মায়া ছিল বড্ড, কারণ কলিজাটা বিশাল যে! বললেন, 'কাদের মারব? এরাই তো কারো ভাই, কারো বাবা।' ভুল করেছিলেন, বড্ড ভুল করেছিলেন রাক্ষসের রক্তবীজের ঝাড় শেষ না করে। তবে আমাদের গ্রামে খলিল চাচা ব্রাশফায়ারে নিজের বাবাকে মারতে দ্বিধা করেননি দালাল বিধায়, থু থু ছিটিয়েছিলেন মরা লাশের মুখে।
ঝ.
'75-র পরবর্তী সরকারের আনুকুল্যেই ফিরে আসে হায়েনাদের দল। বুক ফুলিয়েই। এরপর তো তাদের মিডাস টাচ- যেখানে হাত দেয় সেখানেই সোনা। আশির দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দখলে। চট্টগ্রামে জাতীয় পার্টির ছাত্রনেতা হামিদ ভাইকে সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেইক করল একজন, তারপর হাত ছাড়ে না। আরেকজন কিরিচ দিয়ে এক কোপ! সমানে রগকাটা। আর কী প্ল্যানিং! আশেপাশের গ্রামে প্রথম লজিং টিচার হিসেবে ঢুকে বিয়েশাদি আত্মীয়তা করা। ব্যাস এভাবেই জাহাঙ্গীর নগর পর্যনত দখল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ঘেরেই আছে, প্রগতিশীল ছাত্রদের কারণে (এমনকি ছাত্রদলও এই ব্যাপারে অনেকখানি আপোষহীন!) ডাইরেকট অ্যাকশনে অক্ষম। আর মহাবিদ্যালয়গুলো? ওগুলোও তাদের।
ঞ.
মহাশয়রা। নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করেন। অচিরেই বাংলা হবে তালিবান। লক্ষণ সব দেখা যাচেছ! ছেলেরা কলেমা আবার রিভাইস দিয়ে নামাজ ধরেন, দাড়ি রাখার অভ্যাস করেন। মেয়েরা বোরকা। শরীয়া আইন সমপর্কিত বইগুলো বই মেলাতেই পাবেন। ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ।
'মা গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শানতি প্রিয় শানত ছেলে, তবু শত্রু এলে অসত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি...'
কে বলছে এটা মুক্তিযুদ্ধের গান। এইটা তো 'ক্লোজআপ ওয়ান' নোলক বাবু গাইছে। তাই না মলি?
পুনশ্চ : ছবির ক্যাপশনটা বুদ্ধি খাটাইয়া বুইঝা নেন। তবে হাল জমানায় রঙিন ছবিতে মানুষ দুজনের অবস্থান বদলাইয়া গেছে_ ইহাই বাংলার নিয়তি!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১:২১